বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরও রাজধানীর গুলিস্তানের চাঁদাবাজি আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে। সেনাবাহিনী মাঠে থাকার পরও তাদের তোয়াক্কা না করে ফ্রি-স্টাইলে চালিয়ে যাচ্ছে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড।
গুলিস্তানের বিভিন্ন মার্কেটের ব্যবসায়ীরা প্রতিরোধ গড়ে তুললে তাদের ওপর নেমে আসে পাশবিক নির্যাতন। এমন অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সহযোগিতা চেয়েছে।
গুলিস্তানের আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণে কে?
আত্মগোপনে থেকে গুলিস্তানের আন্ডারওয়ার্ল্ডে নিয়ন্ত্রণ করছে রাজধানীর শীর্ষ চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসী যুবলীগ নেতা আউয়াল হোসেন। তার নামে রয়েছে হত্যা,চাঁদাবাজি, অস্ত্র ও বিস্ফোরক আইনে ২০ টিরও বেশি মামলা। নির্বাচিত কমিটি তোয়াক্কা না করেই দখলে রেখেছে গুলিস্তানের বিভিন্ন মার্কেট। বিদ্যুৎ বিল ,গার্ড বিল, পানির বিল ও ফুটপাতে দোকান বসিয়ে অবৈধ চাঁদাবাজি করে প্রতিমাসে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে যুবলীগ নেতা আউয়ালের সন্ত্রাসীরা।
২০২২ সালের ৩ মার্চ যুবলীগের একদল সন্ত্রাসী যুবলীগ নেতা আউয়ালের নেতৃত্বে মার্কেটের নির্বাচিত সভাপতিকে হত্যার উদ্দেশ্যে ধারালো অস্ত্র দিয়ে উপুর্যপরি আঘাত করে মার্কেট থেকে চলে যায়। নির্বাচিত কমিটিকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে মার্কেট থেকে বের করে দেয় এবং অবৈধভাবে মার্কেট মালিক সমিতির কার্যালয় দখল করে তাদের সন্ত্রাসীবাহিনী দিয়ে মার্কেট পরিচলনা শুরু করে। এ ঘটনায় বংশাল থানায় মামলা করা হলে পুলিশ যুবলীগ নেতা সন্ত্রাসী আউয়ালকে মুল আসামি করে আদালতে চার্জশিট দেয় (মামলা নং-জিআর ১৪৬)। এরপর থেকে জাকের সুপার মার্কেটে ত্রাসের রাজত্ব কয়েম করে সন্ত্রাসী আউয়াল বাহিনী।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতাগ্রহণের পর যুবলীগ নেতা আউয়াল এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। তবে সেনাবহিনী, পুলিশ ও সরকারকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আউয়াল তার সন্ত্রাসী ক্যাডার বাহিনী দিয়ে এখনও জাকের মার্কেটে সন্ত্রাসী ও চাঁদাবজি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। যার নমুনা গত ৬ আগস্ট মার্কেটের সভাপতি ও পুর্নাঙ্গ কমিটি মার্কেটে তাদের নিজ নিজ ব্যবসা দেখার জন্য মার্কেটে প্রবেশ করলে সন্ত্রাসী আউয়াল বাহিনী তাদের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এতে মার্কেট সভাপতি মো. ফিরোজ আহমেদ গুরুতর আহত হয়ে হাসাপাতালে ভর্তি হন। এরপর আবারো গত ১০ আগস্ট নির্বাচিত দোকান মালিক সমতির কার্যালয়ে হামলা চালায় আউয়াল গং। এসবের প্রতিবাদে গুলিস্থান ফুলবাড়িয়া সুপারমার্কেট-২ ব্লক-সি ( জাকের সুপার মার্কেট ) এর ব্যবসায়ী সমিতি সরকারের সহযোগিতা চেয়েছে। গুলিস্তাকে চাঁদাবাজমুক্ত এলাকা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন তারা।
আউয়াল হোসেন ৩৩ নং ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি ও কাউন্সিলর
আউয়াল গংদের তালিকা
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা যায়, আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে বেশকিছু ছদ্মবেশী ব্যবসায়ী সন্ত্রাসী দ্বারা এসব চাঁদাবাজি-দখলদারিত্ব করাত আউয়াল। এরা গুলিস্তানের জাকের মার্কেটকে বানিয়েছে নিজেদের অভয়ারণ্য। এরা অনেকে নামধারী ব্যবসায়ী, কেউরা বহিরাগত। মূলত এরা আউয়ালের পোষা সন্ত্রাসী। তাদের নামগুলো হলো- তাজুল ইসলাম (জাকের মার্কেট), আনোয়ার হোসেন (জাকের মার্কেট), জুবায়ের আহমেদ (জাকের মার্কেট), মোহাম্মাদ মাসুম (জাকের মার্কেট), মোহাম্মাদ আব্দুল আউয়াল শাহিন (জাকের মার্কেট), আল আমিন (সিটি প্লাজা), মো. মিলন (সিটি প্লাজা), মো. নোমান খান (সিটি প্লাজা), নাঈম (সিটি প্লাজা), মো. রুহুল (নগর প্লাজা), মো. ওবায়দুল (সিটি প্লাজা)।
যা বলছে ব্যবসায়ীরা
গুলিস্তান ফুলবাড়িয়া সুপারমার্কেট-২ ব্লক-সি (জাকের সুপার মার্কেট ) এর ব্যবসায়ীরা চাঁদাবাজ এবং দখলদারে অতিষ্ঠ হয়ে প্রতিকারের জন্য সরকারের সহযোগিতা চাচ্ছে।
মার্কেটের ব্যবসায়ী মোস্তাক আহমেদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: এই মার্কেটের ৪৫১ জন দোকান মালিক ও দুই হাজার কর্মচারি চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসীদের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। আমরা সাধারণ ব্যবসায়ী, আমরা স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতে চাই। আমরা চাঁদা দিয়ে ব্যবসা করতে চাই না।
ব্যবসায়ী কামরুজ্জামান বলেন, মার্কেটের বিদ্যুৎ বিল, গার্ড বিল, পানির বিলের নামে অতিরিক্ত টাকা আদায় ও ফুটপাতে দোকান বসিয়ে অবৈধ চাঁদাবাজি বন্ধের আহ্বান জানাই। আমরা প্রতিবাদ করলে আমাদেরই ‘চাঁদাবাজ’ তকমা বসিয়ে দেওয়া হতো। আমরা আমাদের নির্বাচিত দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ফিরোজ আহমেদ ও মালিক সমিতির পূর্ণাঙ্গ কমিটিকে সাথে নিয়ে মার্কেটের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করতে চাই।
নির্বাচিত সভাপতি ফিরোজ আহমেদ
সার্বিক বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে গুলিস্থান ফুলবাড়িয়া সুপারমার্কেট-২ ব্লক-সি (জাকের সুপার মার্কেট) সভাপতি ফিরোজ আহমেদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: ছাত্র আন্দোলনের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে। সেই সাথে সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজ দমনে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী ও পুলিশের যুগোপযোগী পদক্ষেপে আমরা নতুন দিনের স্বপ্ন নিয়ে নতুন প্রেরণায় ব্যবসা শুরু করতে চাই। আমাদের মার্কেট আমরা সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজমুক্ত রাখার উদ্যোগ নিয়েছি। আমাদের এ উদ্যোগে প্রশাসনের সর্বাত্মক সহযোগিতার অনুরোধ করছি। সেইসাথে যুবলীগ নেতা সন্ত্রাসী আউয়াল বাহিনীর দুর্বৃত্তদের হাত থেকে এ মার্কেটকে মুক্ত রাখার অনুরোধ করছি।
চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্ব সম্পর্কে সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন জানিয়েছেন, ‘‘কেউ চাঁদাবাজি করবেন না, দখলবাজি করবেন না। যদি চাঁদাবাজি করেন, তাহলে পা ভেঙে দেওয়া হবে। আমি সেনাপ্রধানকে বলেছি এরকম কর্মকাণ্ড যারা করবে তাদের পা ভেঙে দিতে। আই ডোন্ট কেয়ার ইউ গো টু হেল। আমার কানে এসব আসলে ভালো হবে না।’’
Leave a Reply