যত দিন সুস্থ থাকি, এই মানবিক কাজ করে যাব : পুলিশ জীবন মাহমুদ

মোঃ ছিদ্দিক//ভোলা প্রতিনিধিঃ

ভোলা জেলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার টবগী ইউনিয়নের ৮ নাম্বার ওয়ার্ড। ওই ওয়ার্ডের একটি ছিন্নমূল পরিবারের জন্য একটি টিনের ঘর নির্মান করা হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ঘরের চাবি তুলে দেয়া হলো ষাট ছুঁই ছুঁই বয়সের মো. নান্টু মিয়ার পরিবারের হাতে। ওই নান্নু মিয়ার স্ত্রী জয়নব বিবি অশ্রুসিক্ত চোখে জানালেন, প্রায় তিন শতক জমির উপর ওই ঘর করে দিয়েছেন।পুলিশ সদস্য জীবন মাহমুদ। এখন তাঁদের বর্ষা আর শীতের কষ্ট করতে হবেনা। এখানে আগে তাঁরা চারটি খুঁটির উপর পলিথিন, খড় দিয়ে কোন রকমে থাকতেন।

বর্ষায় ভিজতেন, শীতে জুবুথুবু হয়ে থাকতেন।কিছুক্ষণ পর আরেকটি ওয়ার্ডে ৪ টি অসহায় পরিবারের হাতে তুলে দেয়া হলো একটি করে টিনের ঘর করার জন্য যাবতীয় সামগ্রী। সামগ্রী পাওয়াদের মধ্যে আয়েশা ও জামালউদ্দিন জানান, তাঁদের মাথা গোজার ঠাই করে দিয়েছেন জীবন মাহমুদ।কিছুদুর গ্রামের দিকে আগাতেই দেখা কানন বেগমের সাথে। তাঁর হাতে একটা বকরি ছাগলের রশি। ছাগল ঘাস খাচ্ছে। সাথে দুটি ছাগলের বাচ্চা।তিনি জানালেন, এ ছাগল কিনে দিয়েছেন জীবন মাহমুদ। বাচ্চা দুটি বড় হলে তাঁর মুলধন হয়ে যাবে।তার একটু আগেই মনিরাম বাজার।

ওই বাজারে বাক্ প্রতিবন্ধী হাতেম আলী ক্ষুদ্র দোকান করছেন। হাতেম আলী জানালেন, পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত টেনেটুনে লেখাপড়া করেছেন। একেতো মুখের কথা অধিকাংশ বুঝা যায়না অন্যদিকে পড়াশুনায়ও ভালো ছিলেন না। তাই লেখাপড়া আর এগোয়নি। ১০-১২ বছর চাসহ অন্যান্য মালামাল বিক্রির দোকান করেছেন। বাকি নিয়ে কাষ্টমার টাকা দেয়নি। খেয়ে না খেয়ে দিন চলছিলো। তখন জীবন মাহমুদ এ দোকান করে দেন।এখন পরিবার পরিজন নিয়ে ভালো আছি। পাশাপাশি বৃদ্ধ বাবা-মাকেও সেবা করতে পারিছি। যদিও তাঁর দুই ভাই আ. হালিম ওমান ও আ. মতিন সিঙ্গাপুর থাকেন কিন্তু তারা বাবা-মার খোঁজও নেন না।মনিরাম বাজার থেকে ৫-৬ কিলোমিটার দূরে হাসানগর ইউনিয়নের কাজির হাঁট বাজার। সেখানে দেখা যায় দৃষ্টি প্রতিবন্ধি শাহিন দোকান করছেন।শাহিন জানান, কয়েক বছর আগে ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় তাঁর দুটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়। ফলে তিনি দৃষ্টি শক্তি হারান। সংসারে বাবা নেই। মা আর চতুর্থ শ্রেণি পড়ূয়া ছোট বোন। যখন না খেয়ে থাকার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তখন জীবন মাহমুদ এ দোকান করে দেন; মালামাল কিনে দেন। দোকানে বিক্রিও ভালো। এখন মা আর বোনকে নিয়ে অনেক ভালো আছেন।উপজেলার টবগী ইউনিয়নের মুলাইপত্তন গ্রামের জান্নাত বেগমের স্বামী মারা গেছেন প্রায় তিন বছর।

তাঁর স্বামী আ. রাজ্জাক শরিফ ইমামতির বেতনে সংসার চালাতেন। স্বামী মারা যাবার পর তিন সন্তানের জননী জান্নাত চোখে-মুখে অন্ধকার দেখেন। জান্নাত বেগম জানান, একদিকে সংসারের খরচ অন্যদিকে সন্তানদের পড়াশোনার খরচের চিন্তায় তাঁর পাগল হয়ে যাবার মতো অবস্থা হয়েছিল। একদিন জীবন মাহমুদ একটি শিলাই মেশিন নিয়ে তাঁর বাড়িতে হাজির হন।টুকটাক সেলাইর কাজ জানেন। বাড়ির আশে-পাশের মহিলা ও বাচ্চাদের অর্ডার পান। মোটামুটি আয় হয়। আগের চেয়ে ভালো আছেন। হাসাননগর ইউনিয়নের অটো চালক মিজানুর রহমান, টবগী ইউনিয়নের মো. নয়ন জানান, দূর্র্ঘটনায় তাঁদের হাত পা কেটে ফেলতে হয়েছে। জীবন মাহমুদ তাঁদের কৃত্রিম হাত-পা কিনে সংযোজন করে দিয়েছেন।জীবন মাহমুদ এলাকায় একটি সার্বক্ষণিক অটোর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ওই অটোর ড্রাইভারকে কোন রোগীকে হাসপাতালে নেয়ার দরকার হলে হাজির হয় রোগীর বাসার দরজায়। স্থানীয়রা এটাকে গরীবের এ্যাম্বুলেন্স বলে।

দু:স্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ব্যাপারে জানতে চাইলে জীবন মাহমুদের শিক্ষক হাফিজ ইব্রাহিম মহাবিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মো. জাকারিয়া আজম বলেন, আমার কাছে মনে হয় জীবন মাহমুদের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রবনতা সহজাত। সে কলেজে পড়ার সময় অসহায় মানুষকে রক্ত দান করতো।দরিদ্র কোন শিক্ষার্থী ফরম ফিলাপ করতে না পারলে তাঁর পাশে দাঁড়াতো। এখন কর্মজীবনেও যেভাবে দু:স্থ মানুষের পাশে আছে-তা এক কথায় অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।দ্বীপজেলা ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার টবগী ইউনিয়নের ৭ নাম্বার ওয়ার্ডের শাহাবুদ্দিন মিয়ার একমাত্র ছেলে সন্তান জীবন মাহমুদ। তিনি ২০২০ সালে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে যোগদান করেন। বর্তমানে কর্মরত আছেন বরিশালে। পুলিশে যোগদান করার পর রাস্তাঘাটে ডিউটি করতে গিয়ে দুস্থ মানুষের অসহায়ত্বের চিত্র দেখতে পান জীবন মাহমুদ।সামর্থ্য অনুযায়ী কিছু অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন আর কিছু অসহায় মানুষের চিত্র ফেসবুকে পোস্ট করে সাহায্য চেয়েছেন।

অনেকেই এসব অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে চান। তখন চিন্তা করলেন মানুষের উপকারে ফেসবুক একটি দারুণ প্লাটফর্ম। এই প্লাটফর্মকে মানব কল্যাণে কাজে লাগাতে হবে। সেই থেকে শুরু।তিনি বলেন, ফেসবুকের মাধ্যমে বিভিন্ন সমস্যার পরামর্শ ও রক্তদাতার সন্ধান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হয়রানিমূলক বিষয়গুলোতে সাহায্য করা, আইনি সহায়তা ও পরামর্শ দেয়া হয়।এমনকি রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষদের ঘর করে দেয়া হয়েছে আমার বেতন এবং কিছু অনলাইন শুভাকাঙ্খীর সহযোগিতায়। এখন পর্যন্ত ভোলা ও বরিশাল জেলায় ৪৪ টি অসহায় পরিবারকে টিনের ঘর করে দেয়া হয়েছে। ক্ষুদ্র ব্যবসার মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে ৫৩ টি পরিবারকে।এ মুহূর্তে ৩৮ জন এতিমকে খাবার সহ এতিমখানার পড়াশোনার বেতন-ভাতা পরিশোধ করছেন। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য আছে সুদমুক্ত ঋনের ব্যবস্থা। এরজন্য প্রয়োজন নেই কোন জামানত কিংবা খোলা তারিখের। যখন দরকার তখনই পাওয়া যায় এই সুদমুক্ত ঋন। ১৯ জন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বর্তমানে সুদমুক্ত ঋন নিয়ে ব্যবসা চালাচ্ছেন।

যেকোনো বিষয়ভিত্তিক সমস্যার সমাধানও দেয়ার চেষ্টা করেন জীবন মাহমুদ। কারো পুলিশি বা ডাক্তারি সেবা এবং আইনি পরামর্শ লাগলে ফেসবুকে পোস্ট করেন আর মুহূর্তে মিলে পরামর্শ। হয়ে যায় সমস্যার সমাধান, এই ফেসবুক আইডিতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রক্তের প্রয়োজনের অনুরোধ আসে। এ পর্যন্ত প্রায় শত শত ব্যাগ রক্ত ম্যানেজ করে দিয়েছেন।প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ শুরু করে ইতোমধ্যে ৩৫ জন শারীরিক প্রতিবন্ধীকে হুইলচেয়ার উপহার দিয়েছেন জীবন মাহমুদ। বেওয়ারিশ লাশ দাফন কিংবা দাফনে অসমর্থ ব্যাক্তির দাফন-কাফনের ব্যবস্থা সব সময় উন্মুক্ত রেখেছেন তিনি।অর্থের উৎস সর্ম্পকে জানতে চাইলে জীবন মাহমুদ বলেন,বর্তমানে আমার মানবিক কাজে জুঁই আক্তার নামের এক আমেরিকা প্রবাসী সবচেয়ে বেশী সহযোগিতা করেন। তিনি ১৮ তম বিসিএস পরীক্ষায় ভেটেনারী সার্জন হিসেবে যোগদান করে পরে চাকরি ছেড়ে সপরিবারে আমেরিকা চলে যান।এছাড়া প্রবাসী পুলিশ, আইনজীবী ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষও সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেন। জীবন মাহমুদের স্বপ্ন একটি ডিজিটাল এতিমখানা ও মাদরাসা গড়ার। যেখানে কুরআন শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক সব শিক্ষা থাকবে, সব সুযোগ-সুবিধা পাবে শিক্ষার্থীরা। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের আগে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য নিবেদিত প্রাণ হয়ে মানুষের জন্যই কাজ করে যেতে চান তিনি।


Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *